Saturday, 29 April 2017

বেদ সনাতন ধর্মের প্রধান এবং আদি ধর্মগ্রন্থ।কিন্তু জীবনে একবার এই মহানগ্রন্থ পড়ে দেখা দূরের কথা, অধিকাংশই বেদকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান না।

নমস্কার
আমরা সবাই জানি বেদ সনাতন ধর্মের প্রধান এবং আদি ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু প্রায় ৯০% হিন্দু তাদের জীবনে একবার এই মহানগ্রন্থ পড়ে দেখা দূরের কথা, অধিকাংশই বেদকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান না।
যার ফলশ্রুতিতে ধর্মের প্রতি আমাদের অনেক ভুল-ভ্রান্তি এবং অজ্ঞতা থেকে যায়। নিজেদের গৌরবের বিষয়টুকু আমাদের জানার বাইরে থেকে যায়।
যুগে যুগে অনেক জ্ঞানী, মনীষীরা বেদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে গেছেন।বেদকে মানব-সভ্যতার বিকাশের সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে গেছেন।কিন্তু আমরা এই মহান গ্রন্থের চর্চা করা থেকে নিজেদের বঞ্চিত রেখেছি।
আমার মনে হয় বেদকে শুধুমাত্র একটি ধর্মগ্রন্থ ভাবলে ভুল হবে,কারন বেদে এমন অনেক বিষয়ের উপর ব্যাখ্যা করা আছে, যা আমাদের কল্পনাতীত এবং আশ্চর্যজনকও বটে।
বেদকে বলা হয় অপৌরুষেয়।অর্থ্যাৎ যা কেউ রচনা করেন নি এবং তা পরমাত্মার নিকট থেকে স্ব-নির্গত হয়েছে। আর বেদের এই শ্লোক গুলোকে মুনি-ঋষিরা প্রত্যক্ষ করেছে। তাঁরা হলেন বেদ মন্ত্রের দ্রষ্টা। বেদকে প্রধানত ৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং অপ্রধানত ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।প্রত্যেক ভাগে নিদিষ্ট বিষয়ের উপর বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
তাছাড়া বেদের অনেক বিষয় বস্তু রয়েছে যা আমাদের প্রত্যেকেরই জানা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষাপটে চতুর্বেদ অধ্যয়ন করা আমাদের সকলের পক্ষে সম্ভবপর নয়।মহর্ষি বেদব্যাস তাই মানব জাতির বুঝার স্বার্থে বেদকে চার ভাগে ভাগ করে তাঁর চার শিষ্যকে ভিন্ন ভিন্ন বেদকে প্রচারের দ্বায়িত্ব অর্পন করেছিলেন। কিন্তু আমাদের পক্ষে পুরো বেদ আয়ত্ত করা সম্ভবপর না হলেও আমাদের প্রত্যেক সনাতনদের বেদ সম্পর্কে ক্ষুদ্র হলে কিছুটা ধারনা থাকা উচিত।
তাই আজ আপনাদের চার বেদের সংক্ষিপ্ত এবং প্রাথমিক ধারনা লাভের জন্য দুটো বইয়ের পিডিএফ দেব, যা থেকে আপনারা বেদ সম্পর্কে সামান্য হলে গুরুপ্তপূর্ন অনেক কিছুই জানতে পারবেন।
বইয়ের নাম-
.
১)বেদসার সংগ্রহ;
ডাউনলোড লিংক:https://db.tt/cJVNW7bq
.
২)বেদ পরিচয়;
ডাউনলোড লিংক:https://db.tt/epzWOfLS
.
উল্লেখ্য, PDF বই পড়তে গেলে Adobe Acrobat Reader এই সফটওয়্যারটি আপনার ডিভাইসে ইন্সটল করে নিতে হবে।
যাদের ডিভাইসে এই সফটওয়্যার নেই বা ডাউনলোড করতে চান, তারা এই লিঙ্কে সফটওয়্যারটি পাবেন

Friday, 14 April 2017

বেদ

বেদ

সৃষ্টির প্রারম্ভে জীবের কর্তব্য কর্ম কিরূপ হবে তা নির্ধারক হিসাবে শ্রীভগবান তার মুখ থেকে বেদরূপ চতুষ্কুমারের উৎপত্তি করেন এবং তা ব্রক্ষ্মান্ডের অধিকর্তা ব্রক্ষ্মার কাছে অর্পন করেন । কিন্তু কল্পান্তে মূর্তিমান অজ্ঞানরূপী দৈত্য বেদ চতুষ্টয়কে অপহরণ করে রসাতলে নিয়ে যায় । তখন ভগবান হয়গ্রীব (অর্ধ অশ্ব ও অর্ধ নর) রূপ ধারণ করে বেদ চতুষ্টয়কে উদ্ধার করে পুনরায় ব্রক্ষ্মাকে সমর্পণ করেন । তখন ব্রক্ষ্মা বেদগণকে তাঁর হৃদয়ে ধারণ করেন এবং পরবর্তীতে ব্রক্ষ্মা তাঁর পূর্বাদি মুখ থেকে ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব নামক চারটি বেদ এবং এই বেদ থেকে আরো অনেক উপবেদ প্রকাশিত করেন ।
বেদ শব্দটি আসছে বিদ্ থেকে । বিদ্ শব্দের অর্থ জ্ঞান । যার মধ্যে বিদ্ বা জ্ঞান আছে তিনি বিদ-বান বা বিদ্বান (যেমন, ধন আছে যার ধনবান) ।
বর্তমানে বিদ্বান বলতে কোনো খেতাবধারী উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিকেই বুঝায় যা আদৌ মূল বেদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কি না তা সাধারণত বুঝে উঠতে পারা যায় না । কিন্তু শাস্ত্রীয় প্রমাণুসারে এমন কোন কিছু নাই যা ভগবান ব্যতিরেকে সৃষ্টি হয়েছে । ভগবানই হচ্ছেন মূল স্রষ্টা । পরে হয়তো অনেকেই ভগবদ কৃপায় ভগবানের সৃষ্টিকে আরো সুন্দর রূপ দান করেছেন । যেমন ভগবান নারায়ণ ব্রক্ষ্মাকে প্রথম ৪টি শ্লোকে ভাগবত পুরাণ বলেছিলেন যা চতুর্শ্লোকী ভাগবত বলে পরিচিতি । পরে তিনি দশ শ্লোকে নারদকে বলেন, পরবর্তীতে এই ভাগবত পুরাণই ১৮,০০০ শ্লোকে ব্যাসদেব রচনা করেন । তেমনই সমস্ত জ্ঞানের মূল ভিত্তি হচ্ছে এই চারটি বেদ যা ঋক, সাম, যজু ও অর্থব বেদ নামে পরিচিতি এবং এই বেদগুলিই মনুষ্য সমাজের কার্য নির্বাহক জ্ঞান দান করে থাকে । প্রত্যেকটি বেদেই সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণের ওপর যা বর্ণাশ্রমের অর্থাৎ ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য সৃষ্ট যাতে তারা ক্রমান্বয়ে আরো উন্নততর স্তর লাভ করতে পারে । যেমনঃ সত্ত্বগুণের আশ্রিত ব্রাক্ষ্মণ শুদ্ধ সত্ত্বগুনের স্তরে উঠতে পারে । রজোগুণের আশ্রিত ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা রজঃ বা সত্ত্বঃ গুণের স্তরে উঠতে পারে । তেমনি তমোগুণাশ্রিত শূদ্ররা ক্রমে রজঃ ও সত্ত্বঃ গুণে উঠতে পারে । তারই বিধান বেদে স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে । বেদে গুণস্তর ভেদে অনেক প্রকার যজ্ঞের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যার দ্বারা স্বর্গের দেবতাদের সন্তোষ বিধান করা যায় ।
মূলত আমরা যত প্রকার দুঃখ বা ক্লেশ পেতে থাকি তার মূল বিভাগ হচ্ছে ৩ প্রকার । আধি ভৌতিক যা অন্য প্রাণীর থেকে পেয়ে থাকি, আধ্যাত্মিক যা মন থেকে পেয়ে থাকি এবং আদিদৈবিক যা দেবতাদের থেকে পেয়ে থাকি । এই তিন প্রকার ক্লেশেরও সরাসরি নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন বিভিন্ন দেবতা । যেমনঃ মনের থেকে যে ক্লেশ পেয়ে থাকি সেই মনের পরিচালক হচ্ছেন সোমদেব । খাদ্য হজম, ইন্দ্রিয় পরিচালনা সবকিছুই করে এক একজন দেবতার সক্রিয় পরিচালনায় । তাই দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধানের মাধ্যমেই আমরা ক্লেশ বা দুঃখ থেকে মুক্ত হতে পারি । বেদের নির্দেশানুসারে জীবন-যাপন করলেই আমরা সুখী হতে পারি এবং এটা কর্তব্য কর্ম নিরূপণ করে ।
‘বেদপরস্থাৎ ধর্ম, অধর্মস্ত বিপর্যয় ।’
আমরা চারি বেদের প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারি ।

যজুর্বেদ

এর মূলত দুইটি বিভাগ, তৈত্তিরীয় বা কৃষ্ণ যজুর্বেদ এবং বাজসনেয় বা শুক্ল যজুর্বেদ । মহর্ষি বৈশস্পায়ণ এই বেদ সংকলনের মাধ্যমে সমাজ পরিচালনায় বিভিন্ন পন্থা নির্দেশ করেছেন । এতে মূলত ক্ষত্রিয় নীতি যা সাম-সন্ধি বা মৈত্রী স্থাপনের মাধ্যমে, দাম-বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে, দন্ড-শাসন করে বা দন্ড দিয়ে এবং ভেদ-বৈলক্ষণ বিচ্ছেদের মাধ্যমে সমাজ পরিচালনার শিক্ষা বর্ণিত আছে । এতে বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র যথা অগ্নি, জল, বায়ু, আকাশ, অস্ত্রের আবাহন ও প্রয়োগ পদ্ধতি বর্ণিত আছে । বর্তমানে কেবলমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র ব্যতিরেকে অন্যান্য অস্ত্রের বিলুপ্তি ঘটেছে । বাৎসায়ন ব্রক্ষ্মচারী এই যজুর্বেদের অধ্যাপনা করে কামশাস্ত্র নামক শাস্ত্র প্রণয়ন করেন যার দ্বারা সমাজে সুশৃঙ্খল পরিবার গঠনের প্রণালী বর্ণনা করেছেন । পরিশেষে শুক্ল যজুর্বেদে বাজসনেয় বিভাগে কীভাবে মানুষ নিজেকে সন্তুষ্ট রেখে আধ্যাত্মিকতার উর্ধ্বস্তরে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করা যায় তার বিধান বর্ণনা করে ।

অথর্ব বেদ

মহর্ষি অঙ্গিরা এই বেদের অধ্যাপক । তিনি প্রথম এই বেদকে দুইটি ভাগে ভাগ করেন । একটি আয়ুর্বেদ শাস্ত্র এবং অন্যটি বাস্তু শাস্ত্র । বাস্তু শাস্ত্রে স্থাপত্য নির্মাণ প্রণালী প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি আছে । আয়ুর্বেদ চিকিৎসা প্রণালীকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে । এগুলো হলো চরক সংহিতা ও শুশ্রুত সংহিতা । পরে মহর্ষি বাণভট্ট এই সংহিতাদ্বয় থেকে ৮টি পৃথক পৃথক গ্রন্থ প্রণয়ন করে ।
১) শল্য তন্ত্র বা অস্ত্রোপচার এবং খার অগ্নি প্রয়োগ প্রণালী ।
২) শালাক্য তন্ত্র – চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, ওষ্ঠ, দাঁত, অধর, তালু ও আলজিহবা চিকিৎসা (ent) ।
৩) কায় চিকিৎসা – জ্বর, অতিসার, রক্তপিত্ত, উন্মাদ, কুষ্ঠ, মেহ ইত্যাদির চিকিৎসা প্রণালী ।
৪) ভূতবিদ্যা – দৈত্য, নাগ, পিশাচ, যক্ষ, রক্ষ, গ্রহাদির শান্তিকর্ম, বলিদান ইত্যাদি ।
৫) কৌমারভূত্য তন্ত্র – ধাত্রী ও শিশুপালন, দুগ্ধাপ্লতা ।
৬) অগদ তন্ত্র – সর্পদংশনাদির চিকিৎসা ।
৭) রসায়ন তন্ত্র – পরমায়ু, মেধা, বল বর্ধক ও শরীরচর্চা, ব্যায়াম ইত্যাদি ।
৮) বাজীকরণ – শুক্রঘটিত রোগ নিরাময়, শরীর ও মন প্রফুল্ল রাখার প্রণালী ।
পরিশেষে শরীরই ধর্ম সাধনের মূলক্ষেত্র – শরীরম্‌ আদ্যং খলু ধর্মসাধনম্‌ ।

সামবেদ

মহর্ষি জৈমিনী এই বেদের অধ্যাপকতা করেন, তার প্রধান ৭ জন শিষ্যের নামানুসারে ৭টি স্বর – সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি – এর সুর সংযোজন করেন । এই ৭ জন শিষ্য হলেন সারজ, হৃষব, গান্ধার, মধ্যম, পঙ্কজ, ধৈতব ও নিষাদ । এতে সুরের বিভাগানুযায়ী ১০টি ঠাট আছে এবং অসংখ্য রাগ রাগিণীর সংলাপ আছে । এই সামবেদের মাধ্যমে মনের স্তরের বিনোদন করে আত্মোপলব্ধি করতে পারি ।
বিষ্ণুসারথী গরুড়দেব যখন প্রভুকে নিয়ে গগন মার্গে ভ্রমণ করেন তখন তিনি এই সামবেদেরই কীর্তন করেন । নারদ মুনি বীণা সহযোগে কীর্তন করে সর্বত্র ভগবানের মহিমা প্রচার করেন এবং এই কলিযুগের মূল যুগধর্মই হচ্ছে কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ ।

ঋকবেদ

মহর্ষি পৈল এই বেদের অধ্যাপনা করেন । এই বেদ বিশেষ করে ব্রাহ্মণ ধর্ম, দশবিধ সংস্কার, বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা, গায়েত্রী মন্ত্র, ব্রাহ্মণদের কর্তব্য কর্ম, সন্ন্যাসী বিভাগ—কুটিচক, বহূদক, পরিব্রাজক, পরমহংসদের কর্তব্যকর্ম, যোগের প্রণালী (যম নিয়মাদি), দেবতা পূজার্চনাদি, হোম, যজ্ঞ ইত্যাদির মাধ্যমে নিজে ও অপরের কল্যাণসাধন করে ।
ঋকবেদের সিধান্তানুযায়ী কেবল ব্রহ্মণরাই সমস্ত বেদ অধ্যায়ন করবে এবং প্রয়োজনে যার যতটুকু প্রয়োজন তাকে কেবল ততটুকুই দান করবে । তার ফলে বেদের মান অবিকৃতভাবে বজায় থাকবে ।
পরিশেষে বেদের চূড়ান্ত নির্ণয় যা শ্রীল ব্যাসদেব শ্রীমদ্ভাগবতের সূচনায় উল্লেখ করেছেন এবং তা হচ্ছে সত্যং পরং ধীমহি – পরম সত্যের ধ্যান করা । শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী উল্লেখ করেছেন “লোকে কেনে পড়ে-(শুধু) কৃষ্ণ জানিবারে । কৃষ্ণ না জানিল, তবে বিদ্যায় কি করে ।।” আমরা যতই বিদ্যালাভ করি ততই আমাদেরকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হওয়ার বিদ্যালাভের সফলতা নির্ণয় করে কেননা গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন – বেদৈশ্চ সর্বৈঃ অহম্‌ এব বেদ্যঃ । (গীতা ১৫/১৫) সমস্ত বেদের মূল বিদ্যা হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা ।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ।।